বাংলাদেশের প্রধান জনবহুল দ্বীপ সন্দ্বীপ বর্তমানে যে আয়তন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত তাতে এটাকে অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাসের একটি উচ্ছিষ্ট বলা যায় মাত্র। ভাবতেও অবাক লাগে যে, সন্দ্বীপ এক সময় একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিলো। সে সব এখন এমনই এক স্মৃতি যার লালন আমাদের মনে কেবল বেদনাবোধই সৃষ্টি করে। সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব,চিত্তহারী নিসর্গশোভা, স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং সর্বোপরি বিভিন্ন রকমের কৃষি উৎপাদনে, বনজ ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ এ ভূখণ্ডটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিকট ও দূরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আধিপত্য বিস্তারে প্রলুব্ধ করে। পরিণামে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সন্দ্বীপের মাটি। বিশেষ করে পর্ত্তুগীজ জলদস্যু ও মগ হার্মাদদের নৃশংসতার শিকার হতে রয়েছে সন্দ্বীপকে বারবার।
গত কয়েক শতাব্দীতে সন্দ্বীপের ভূখণ্ডগত বা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং দখলদারিত্বের এতো ঘনঘন পরিবর্তন হয় যে, এর ধারাবাহিক বর্ণনা প্রদান বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের সংকীর্ণ পরিসরে অসম্ভব বটে। প্রাপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে এ সবের উল্লেখ এতো অসংলগ্ন ও অপর্যাপ্ত যে, সেসব তথ্য এক সূত্রে গ্রথিত করে একটি সময়ানুক্রমিক প্রতিবেদন তৈরী করা অত্যন্ত কঠিন গবেষণা ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার। তাতেও ঘটনা প্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ পাওয়া সহজ হবেনা। উল্লেখিত পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ওপর একটা কারসরি গ্লান্স্ (cursory glance) দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। আমার ধারণা, সন্দ্বীপের ইতিহাস প্রণেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার আড়ালে নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। যে পরিমাণ শ্রম দিলে ও আন্তরিকতা থাকলে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটি মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য ইতিবৃত্ত দাঁড় করানো যায়, তার অভাব সংশ্লিষ্ট লেখকগণ গোপন করতে পারেননি।
প্রাচীন সন্দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান শ্রীপুরের অর্থাৎ বর্তমান বিক্রমপুরের ১৮ মাইল দক্ষিণে ছিলো। তৎকালীন বঙ্গের সুবেদার টোডরমল্ল রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে ১৫৮২ সালে সন্দ্বীপ, হাতিয়া, বামনী ও সাগরদিহি নামক চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে সন্দ্বীপ পরগণা গঠন করেন। এটাই হলো সন্দ্বীপ পরগণা গঠনের ইতিহাস। তখনকার দিনে সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও বামনী পরস্পরের এতো কাছাকাছি অবস্থিত ছিলো যে, ভাটার সময় হেঁটে এবং জোয়ারের সময় সাঁতরে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাওয়া যেতো। ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে বামনী দ্বীপ এক সময় নোয়াখালীর ভূখণ্ডের সাথে এবং সাগরদিহি হাতিয়ার সাথে একীভূত হয়ে যায়। আর হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ জলভাগ এবং জনপদ বিলুপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয় ২৫ মাইল প্রশস্ত খরস্রোতো নদী। উল্লেখ্য, ১৫৬৫ খৃস্টাব্দে হাতিয়া ও বামনীসহ সন্দ্বীপের আয়তন ছিলো ৬৩০ বর্গমাইল। রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে সন্দ্বীপের আয়তন ৪১৭.৬৬ বর্গমাইল ছিলো বলে দেখা যায়। অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে সংকুচিত হতে হতে এই দ্বীপের আয়তন বর্তমানে মাত্র ৭০ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের অভাবে সন্দ্বীপের অস্তিত্ব এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন। অলৌকিক কিছু না ঘটলে আগামী পঁচিশ তিরিশ বছর পর এই দ্বীপের আয়তন ও অবয়ব কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে অনুমান করাও সম্ভব নয়। সন্দ্বীপের লোকদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে খুবই চিন্তার বিষয়।
এদিকে কেউ কেউ অনুমান করেন যে, সন্দ্বীপ এককালে চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশাল একটা অঞ্চল জলভাগে পরিণত হলে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, সন্দ্বীপের বয়স প্রায় তিন হাজার বছর। সে হিসেবে নোয়াখালীর কোনো কোনো এলাকা থেকে সন্দ্বীপের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত। ঠিক কোন্ সময় থেকে ওখানে জনপদ গড়ে ওঠে তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে অনুমান করা যায় যে, সন্দ্বীপে লোকবসতির ইতহাস কমসেকম দেড় দু’হাজার বছরের। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কখন কারা কতোদিন এ অঞ্চল শাসন করে তার আনুপূর্বিক বিবরণ পাওয়া দুষ্কর। তবে ঐতিহাসিক তথ্য হলো এই যে, সপ্তম শতাব্দী থেকে আরবদেশীয় মুসলমানগণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের জন্য দক্ষিণ বঙ্গের সমুদকূলবর্তী চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ এবং দক্ষিণ নোয়াখালী অঞ্চলে যাতায়াত শুরু করে। তারা সেসব স্থানে উপনিবেশও গড়ে তোলে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে সন্দ্বীপ একটি সুপ্রসিদ্ধ বন্দর ও প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র ছিলো। শস্য সম্পদ এবং লবণ উৎপাদন ও ব্যবসায়ের জন্য তখন সন্দ্বীপের সুখ্যাতি সারা ভারতে। প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর তিন শতাধিক জাহাজ সন্দ্বীপের লবণ নিয়ে দেশ-বিদেশে যেতো। ১৭৭৬ খৃষ্টাব্দের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সন্দ্বীপে বছরে এক লাখ তিরিশ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। তাছাড়া তখন জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য দেশে বিদেশে সন্দ্বীপের নাম-ডাক ছিলো। আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে কাঠ এনে সন্দ্বীপের কারিগরদের দ্বারা জাহাজ নির্মাণ করাতেন। সন্দ্বীপের ব্যবসায়ীরা নিজেদের নির্মিত জাহাজে করে চীন, বার্মা, জাপান, সুমাত্রা, জাভা এবং এমন কি আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত তেজারত করতেন। তুরষ্কের সুলতানও এক সময় সন্দ্বীপের সুদক্ষ কারিগরদের দ্বারা জাহাজ নির্মাণ করাতেন বলে জানা যায়।
১৫৭৪ খৃস্টাব্দে মোগলেরা পূর্ববঙ্গ জয় এবং ১৫৮২ খৃস্টাব্দে সুবেদার টোডরমল্ল সন্দ্বীপ পরগণাকে সরকার ফতেয়াবাদের অন্তর্ভূক্ত করে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এদিকে বার ভূঁইয়ার অন্যতম কেদায় রায় সন্দ্বীপ পুনরুদ্ধার করে সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। সন্দ্বীপে সামরিক অভিযান চালাবার জন্য কেদার রায় নৌ-যুদ্ধে পারদর্শী সৈন্য নিযুক্ত করেছিলেন। কার্ভালো নামক এক ব্যক্তিকে তিনি সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করে তার সাহায্যে ১৬০২ খৃষ্টাব্দে মোগলদের অধিকার থেকে সন্দ্বীপ দখল করে নেন। কিন্তু কার্ভালো নিজে কেমন করে জানি সন্দ্বীপ দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামে তখন আরাকান রাজের অধীনে বহুসংখ্যক পর্ত্তুগীজ সৈন্য ছিলো। তাদের সেনাপতি ছিলো ইমানুয়েল ডি মেট্টস (Emanuel De-Mattos) নামক একজন কুশলী ব্যক্তি। ওখানকার পর্ত্তুগীজদের অনুরোধে তিনি ৪০০ সৈন্য নিয়ে কার্ভালোকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। সুচতুর কেদায় রায় পর্ত্তুগীজদের প্রাধান্য লক্ষ্য করে কার্ভালো ও ডি মেট্টসকে সন্দ্বীপে নিজের স্বত্ব অর্পণ করেন। তখনকার দিনে আরাকানের অধিপতি মেংরাজাগি বা সেলিমসা নিজেকে সন্দ্বীপের রাজা বলে মনে করতেন। স্বভাবতই পর্ত্তুগীজদের প্রাধান্য তিনি ভালো চোখে দেখতেন না। তাছাড়া ডি মেট্টস ছিলো তাঁর অধীনস্থ একজন সেনাধ্যক্ষ। পর্ত্তুগীজগণ বিনানুমতিতে সন্দ্বীপ দখল করায় তিনি তাদের প্রতি বিরক্ত হন। কারণ, আস্কারা পেলে ভবিষ্যতে তারা সেখানে শেকড় গেড়ে বসতে পারে। উল্লেখিত আশংকার কারণে আরাকান রাজ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সন্দ্বীপ অধিকার করার সিদ্ধান্ত নেন।
সন্দ্বীপ দখলে রাখার ও দখল করার জন্য আরাকানী সৈন্য ও পর্ত্তুগীজদের মধ্যে দু’বার যুদ্ধ হয়। উভয় যুদ্ধে পর্ত্তুগীজরা জয়লাভ করে। ওরা ২০০০ আরাকানী সৈন্যকে হত্যা করে এবং তাদের ১৩০টি রণতরী জ্বালিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে, পর্ত্তুগীজদের মাত্র ৬ জন সৈন্য নিহত হয়। এদিকে যুদ্ধে এতোবড়ো বিজয় সত্ত্বেও পর্ত্তুগীজগণ সন্দ্বীপ নিজেদের অধিকারে রাখতে পারেনি। নানান রকমের বৈরী পরিস্থিতি ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে শ্রান্ত-ক্লান্ত সেনাপতি কার্ভালো ৩০টি মাত্র রণতরী নিয়ে শ্রীপুরে কেদার রায়ের নিকট চলে যান। ডি মেট্টস একা সন্দ্বীপ শাসন করতে ব্যর্থ হন। অবশেষে কালে ফতেহ খান নামক এক ব্যক্তিকে সন্দ্বীপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তিনি ১৬০৩ সালে চলে যান চট্টগ্রামে। কিছুকাল পর ডি মেট্টস এর মৃত্যু হলে ফতেহ খাঁ নিজকে সন্দ্বীপের স্বাধীন নরপতি বলে ঘোষণা দেন। এদিকে মৃত্যুর আগে ডি মেট্টস তাঁর এক নাবালক পুত্রের অভিভাবক রূপে পেরু গোমেস (Pero Gomes) নামক এক ব্যক্তিকে সন্দ্বীপ শাসন করার অধিকার দিয়ে যান। কিন্তু তিনি ফতেহ খাঁর নিকট থেকে কখনো সন্দ্বীপ উদ্ধার করতে পারেন নি। ফতেহ খান নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার লক্ষ্যে গোপনে মোগল সুবেদারের সাথে সাক্ষাৎ করে সন্দ্বীপকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তখন তিনি নিজেকে মোগল সেনাপতি বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন।
পর্ত্তুগীজ জলদস্যু গঞ্জালিসের নাম সন্দ্বীপের ইতিহাসে বারবার উল্লেখ আছে। ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে তিনি এদেশে আসেন। জলদস্যুতা এবং কোনো কোনো সময় ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁর পেশা হলেও প্রধান লক্ষ্য ছিলো ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখল করা। সে উদ্দেশ্যে তিনি কিছুটা শক্তি সঞ্চয়ও করেন। এক সময় ফতেহ খান জানতে পারেন যে, গঞ্জালিসহসহ কিছুসংখ্যক পর্ত্তুগীজ দক্ষিণ সাবাজপুরের নিকট নঙ্গর করে আছে। পর্ত্তুগীজদের কোন দুরভিসন্ধি থাকতে পারে আশংকা করে ফতেহ খান একদিন সন্ধের সময় ৬০০ সৈন্য ও ৪০টি রণতরী নিয়ে ওদের আক্রমণ করেন। সারারাত যুদ্ধ করে স্বল্পসঙখ্যক পর্ত্তুগীজের নিকট ফতেহ খার বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিনি নিজেও প্রাণ হারান।পর্ত্তুগীজগণ এই যুদ্ধে জয়লাভ করেও নেতার অভাবে সন্দ্বীপ অধিকার করতে পারেনি। তারা স্টিফেন পালমেরো (Stephen Palmeyro) নামক একজন বহুদর্শী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিকে তাদের অধিনায়ক করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি একদল দস্যুর অধিনায়ক হতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে তাঁরই পরামর্শে গঞ্জালিসকে অধিনায়ক নিযুক্ত করে তাঁরা সন্দ্বীপ অধিকারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।
এদিকে পর্ত্তুগীজদের এ অভাবনীয় সাফল্যের কথা শুনে বঙ্গদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বহুসংখ্যক পর্ত্তুগীজ এসে গঞ্জালিসের দল ভারী করে তোলে এবং সে কারণে তিনি নিজেকে পরাক্রমশালী ভাবতে শরু করেন। অবশ্য তা সত্ত্বেও গঞ্জালিস নিজের শক্তিবলে সন্দ্বীপ বিজয় করতে পারবেন না মনে করে বাকলার অধিপতি রামচন্দ্র রায়ের সাহায্য প্রার্থী হন। রামচন্দ্র রায় সন্দ্বীপের অর্ধেক রাজস্ব পাওয়ার শর্তে সন্দ্বীপ আক্রমণে গঞ্জালিসকে কয়েকটি রণতরী ও ২০০ অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। এদিকে ফতেহ খাঁ’র ভাই বহুসংখ্যক মুসলমান সৈন্য নিয়ে সন্দ্বীপ রক্ষায় সচেষ্ট হন। উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গঞ্জালিস ফতেহ খাঁ’র ভায়ের বাহিনীকে দুর্গে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। কিছুদিনের মধ্যে রসদপত্র ও গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে পড়ায় পর্ত্তুগীজ বাহিনী একটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। এ সময় সন্দ্বীপের অদূরে অবস্থানকারী একটি স্পেনীয় জাহাজ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এই জাহাজের ৫০ জন সশস্ত্র নাবিক ফতেহ খাঁ’র দুর্গ আক্রমণ করে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ সুযোগে গঞ্জালিস ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সন্দ্বীপের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন। ১৬১০ খৃস্টাব্দে সন্দ্বীপে তার সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬১৬ খৃষ্টাব্দে আরাকান রাজ সন্দ্বীপ আক্রমণ ও দখল করেন। যুদ্ধে গঞ্জালিসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তার পরাজয়ের মাধ্যমে সন্দ্বীপে পর্ত্তুগীজ শাসন ও আধিপত্যের চির অবসান হয়।
দেলওয়ার খাঁ বিশেষ করে সন্দ্বীপ পরগণার ইতিহাসে বারবার গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত একজন ক্ষণজন্মা পুরুষের নাম। কিছুটা বাস্তব, কিছুটা কল্পনা, কিছুটা তাঁর সম্পর্কে অজ্ঞতা এই খ্যাতিমান ব্যক্তিটিকে কিংবদন্তীর নায়ক হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে। ইতিহাসে বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখিত তথ্যের সাহায্যে দেলওয়ার খাঁ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তৈরী করা প্রকৃতই দুরূহ কাজ। সাধারণ্যে রাখালরাজ দিলাল নামে বহুল পরিচিত দেলওয়ার খাঁ’র পিতার নাম বোরহান উদ্দিন। তিনি বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। মোগল আমলে ভারতে এসে তিনি সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। সিহাবুদ্দিন তালিশের মতে, দেলওয়ার খাঁ’র বাড়ি ছিলো ঢাকায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় তিনি বাদশাহী নৌ-বাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজের অধিপতি ছিলেন। সেই সুবাদে শত্রু ও জলদস্যুদের সন্ধানে বিস্তীর্ণ নদ- নদী ও সমুদ্র এলাকায় ঘুরে বেড়াবার সুযোগ হয় তাঁর। একজন দুঃসাহসী ও উচ্চাভিলাষী লোক হিসাবে সামান্য পদমর্যাদার তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। থাকার কথাও নয়। স্বাধীনভাবে জীবনযাত্রার এবং নেতৃত্ব করার অদম্য স্পৃহা দেলওয়ার খাঁকে পাগলপ্রায় করে তোলে। এ সময় সুজলা সুফলা সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত ও প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত সন্দ্বীপের ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে। তাঁর মনে হতে থাকে, এই সন্দ্বীপই একদিন বাস্তবায়ন করবে তাঁর স্বপ্ন|
পর্ত্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারে তখন সন্দ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল জনশূন্য ও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিলো। এককালের সমৃদ্ধ জনপদগুলো হয়ে পড়ে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বিচরণ ভূমি। কথিত আছে, ইব্রাহিম খাঁ’র সুবেদারির সময় (১৬১৮-১৬২২ খ্রীঃ) দেলওয়ার খাঁ বেশ কিছু সংখ্যক বাদশাহী প্রজা, তাঁদের ও নিজের পরিবার-পরিজন,আত্মীয়-স্বজন নিয়ে গোপনে সন্দ্বীপে পালিয়ে আসেন। তাঁরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। অপরিসীম সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী এবং স্বাধীনচেতা ও উচ্চাভিলাষী দেলওয়ার খাঁ অতঃপর সন্দ্বীপের যুবাবয়সী লোকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তোলেন। নিজের বাহিনীকে সুসংগঠিত এবং বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিলো। তাই দেলওয়ার খাঁ কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মগ ও মোগলসহ তাঁর সকল প্রতিপক্ষকে যথাসম্ভব তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন যাতে প্রতিরোধের উপযুক্ত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের আগে কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে না মারে। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসাবে তিনি প্রথম প্রথম আরাকান রাজের সামস্ত পরিচয় দিয়ে সন্দ্বীপ পরগণা শাসন করতে থাকেন। কিন্তু মাত্র কিছু দিনের মধ্যে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। আরাকান রাজ স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে, দেলওয়ার খান প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে সন্দ্বীপ শাসন করতে চান এবং আরাকানের অধীনে থাকার বিষয়টি একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
চট্টগ্রাম তখন মগ রাজ্যের আওতাধীন। আরাকান রাজ সিদ্ধান্ত নেন যে, শক্তি প্রয়োগ করে দেলওয়ার খাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া হবে। সেই মোতাবেক বহুসংখ্যক রণতরী ও সৈন্য পাঠিয়ে তিনি সন্দ্বীপ আক্রমণ করেন। দেলওয়ার খাঁ আরাকান রাজের অভিসন্ধি সম্পর্কে আগেই অবহিত ছিলেন। কাজেই আক্রমণ প্রতিরোধে কৌশল ঠিক করে রাখেন। মগ সেনারা সন্দ্বীপে অবতরণ করা মাত্র তাদের প্রতিরোধ না করে দ্বীপের গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ দেন। তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছা মাত্র দেলওয়ার খাঁ’র বাহিনী চারদিক থেকে প্রচণ্ড বিক্রমে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় মগ বাহিনী দিশাহারা ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক আক্রমণকারী সৈন্য ধরা পড়ে বন্দী হয়। অন্যরা কোনো রকমে পালিয়ে যায়। সন্দ্বীপের মগধরা গ্রামটি তখন থেকে মগ সৈন্যদের ধরা পড়ার স্মৃতি বহন করছে।
১৬৬৪ সালের ১৩ই ডিসেম্বর নবাব শায়েস্তা খাঁ বাঙ্গলার সুবেদার হয়ে ঢাকায় আসেন। তিনি এই মর্মে সংকল্প গ্রহণ করেন যে, যেভাবেই হোক দেলওয়ার খাঁকে দমন এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলকে জলদস্যুদের কবলমুক্ত করতে হবে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক দেলওয়ার খাঁকে আহ্বান করা হয় নোয়াখালীতে গিয়ে মোগল সেনানায়কের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের জল চৌকি পাহারার কাজে সাহায্য করার জন্য। আরো বলা হয়, তিনি যেন বাদশাহের নিকট গমন করে আনুষ্ঠানিকভাবে অধীনতা ও আনুগত্য স্বীকার করেন। স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন দেলওয়ার খাঁ অনেক ভেবে-চিন্তে মোগল সুবেদারের প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মতি জানান। পরিণামে অত্যন্ত এুদ্ধ হয়ে শায়েস্তা খান সন্দ্বীপ অধিকার করার সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি মনে করেন যে, দেলওয়ার খাঁকে আর সময় দেয়া ঠিক হবে না। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর সেনাপতি আবুল হাসানের অধিনায়কত্বে মোগলবাহিনী সন্দ্বীপ আক্রমণ করে। উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। হতাহত হয় বহু সৈন্য। কিন্তু দেলওয়ার খাঁ’র বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। তাঁর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং রণকৌশল দেখে মোগল সেনাপতি হতবাক হয়ে যান। সে যাই হোক, এই ব্যর্থতা শায়েস্তা খাঁকে বিক্ষুদ্ধ ও প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। তাই মাত্র ন’দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৮ই নভেম্বর সেনাপতি আবুল হাসানের অধিনায়কত্বে এক বিশাল বাহিনী আবার সন্দ্বীপ আক্রমণ করে বসে। অসম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেও দেলওয়ার খাঁ এবার আর পরাজয় এড়াতে পারেন না। বাধ্য হয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। অতঃপর তাঁকে বন্দী করে পরিবার পরিজনসহ ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে বন্দী অবস্থায় ৮৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দেলওয়ার খাঁ’র পরজায় ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সন্দ্বীপের একটি গৌরবময় সময়ের অবসান ঘটে। দেলওয়ার খাঁ’র বাল্যজীবন ও উত্থান সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত আছে সেগুলো পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত বলেই মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর বাল্যকালও সেখানে কাটেনি। দেলওয়ার খাঁ সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল সন্দ্বীপে রাজত্ব করেন। এই সময়টা সন্দ্বীপের ইতিহাসের সবচাইতে গৌরবিত অধ্যায়। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে দেলওয়ার খাঁ তাঁর নিজের জন্য তেমন কিছু করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। মোগলদের হাতে পরাজিত হয়ে বন্দী হওয়ার সময় তাঁর ঘরে ৫২,০০০ টাকা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। দেলওয়ার খাঁ’র পিতা বোরহান উদ্দিনের মোগল সেনাধ্যক্ষ হিসাবে কোনো এক অভিযানে সন্দ্বীপ গমন, সেখানে কামিলা নাম্নী স্থানীয় একজন মহিলার পাণি গ্রহণ, জন্মের পূর্বে দেলওয়ার খাঁ পিতৃহীন হওয়া, রাখাল বালক হিসাবে কাজ করা ইত্যাদি কল্পকাহিনী মাত্র। দেলওয়ার খাঁ দু’জন নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করেন- এটা বলে কোনো কোনো মুসলমান বিদ্বেষী তাঁকে ইন্দ্রিয়পরায়ণ লোক হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। তাঁরা বলতে চান যে, তখনকার দিনে সন্দ্বীপে উচ্চবর্ণের কোনো হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিলো না। অবশ্য ইতিহাসে এ তথ্যের কোনো স্বীকৃতি নেই। দেলওয়ার খাঁ প্রকৃতই কোনো হিন্দু রমণীর পাণি গ্রহণ করেছেন কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। আর করলেও তিনি হয়তে উচ্চবর্ণের কোনে হিন্দু রমণীকেই বিয়ে করে থাকবেন। কারণ, তখন সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে উচ্চবর্ণের বহু হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিলো।
দেলওয়ার খাঁ’র পুত্র শরিফ খাঁ একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পিতার সঙ্গে কারারুদ্ধ থাকার সময় ঢাকার জিনজিরায় মৃত্যুবরণ করেন। সন্দ্বীপের এই মহান শাসকের অন্যান্য পুত্রের কোনো বিবরণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর কন্যাদের বংশধরগণ সন্দ্বীপেই থেকে যান বলে জানা যায়। সন্দ্বীপে দেলওয়ার খাঁ’র অনেক স্মৃতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একমাত্র দেলওয়ার খাঁ সড়কটি এখনও তাঁর স্মৃতি বহন করছে। পঞ্চাশ বছরকাল স্বাধীনভাবে সন্দ্বীপ শাসন করে তিনি এই দ্বীপের অধিবাসীদের গৌরবান্বিত করে গেছেন। সন্দ্বীপের ইতিহাসে তিনি একজন অবিস্মরণীয় মহাপুরুষ।
সূত্রঃ সন্দ্বীপ উত্তরন,
Post by Rakibul Hasan Rahat
0 coment rios: